এ রায় মেনে নেওয়া যায় না
দীর্ঘ ৪২ বছর পর, বহুপ্রত্যাশিত গোলাম আযমের বিচারের রায় ঘোষিত হল। আজ সকাল ১০.৫২ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ এর মহামান্য চেয়ারম্যান রায়ের প্রারম্ভিক বক্তব্য শুরু করলেন। তিনি জানালেন, ২৪৩ পৃষ্ঠার রায়ের মধ্যে ৭৫ পৃষ্ঠা পড়বেন। ১১ টা ০২ মিনিটে মূল রায় পড়া শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। টানা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তিনি পাঠ করে ফেলেন মূল ৫টি অভিযোগ, এ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে হত্যার পঞ্চম অভিযোগটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যোগসাজসের। সাড়ে ১২ টার পরে ট্রাইব্যুনালের ২য় বিচারক জাহাঙ্গীর হোসেন রায়ের দ্বিতীয় অংশ পাঠ করলেন। ট্রাইব্যুনালের মহামান্য চেয়ারম্যান ১টা ০৭ মিনিট থেকে রায়ের মূল অংশ পড়তে শুরু করলেন। একটানা একটা ৩৭ মিনিট পর্যন্ত একে একে পাঁচটি অভিযোগের সপক্ষে এবং বিপক্ষের মুল যুক্তিগুলো তিনি তুলে ধরলেন। খুব স্পষ্টভাবেই তিনি জানালেন, এই গোলাম আযম ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর এবং কার্যত তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের অঘোষিত শাসক হিসেবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন।
২২ নভেম্বর ১৯৭১ এ পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যান এ ব্যক্তি। কিন্তু এর পরদিন ২৩ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তার পরিকল্পনা ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত বিভিন্ন অক্সিলারি ফোর্স, যেমন রাজাকার, আলবদর, আল শামস সদস্যদের অটোমেটিক ওয়েপন এবং আরও উন্নত অস্ত্র-শস্ত্র সরবরাহ করার অনুরোধ করেন।
মহামান্য বিচারক বলছিলেন, ‘ডকট্রিন অব সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’র কথা। তিনি জানালেন, বিচারে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে গোলাম আযম একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন। তার পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল-শামস নামের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীর সফল কৃতকর্মের দায়ভার তার ওপরেই বর্তায়। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে যে পঞ্চম অভিযোগ সেটি ছিল শিরু মিয়াসহ আরও তিনজন হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততা যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রমাণিত এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি মাত্র সাজা ‘ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট’। ঘড়ির কাঁটা ১টা ৩৭ মিনিট। বিচারক জানালেন তিনি এবার মূল রায়টি পড়বেন। আদালতের ফিসফাস শব্দ থেমে গেছে। পিনপতন নিরবতা। আমার পাশে বসা মুনতাসীর মামুন ইতোমধ্যেই করমর্দন করেছেন আমার সঙ্গে। হাস্যোজ্জ্বল মুখ চারদিক। বিজয়ের চিহ্ন সবার অবয়বে।
১ টা ৩৭ থেকে ১টা ৪০ এ তিন মিনিটে মূল রায়টি পড়লেন বিচারক। ১টি ২টি করে ৫টি সাজার জন্য ঘোষণা করলেন বিভিন্ন মেয়াদী সাজা। সর্বমোট ৯০ বছর। বিচারক বললেন, সর্বোচ্চ সাজা প্রদানই ছিল যথাযথ কিন্তু আসামি বিচারকার্য শুরু করার পর থেকে বয়সের ভারে এবং অসুস্থতার কারণে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৯১ বছর বয়স, শুধুমাত্র সে বিবেচনায় সর্বোচ্চ সাজার বদলে ৯০ বছর সাজা দেওয়া হল।
মিনিট দুয়েক আগে আদালতের যে মুখগুলো ছিল হাস্যোজ্জ্বল সেখানে বিষাদের ছায়া। এ রায় কি পাওনা ছিল! এর জন্যই কি দীর্ঘ অপেক্ষা! এ নরাধম লোকটি তার এ দীর্ঘ জীবনে কোনোদিন অনুশোচনা করেনি, তার পরিবারের সদস্যরাও অনুশোচনা করেনি। তার পুত্র সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত ব্রিগেডিয়ার অনুশোচনার বদলে উল্টো ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে; তার দল জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠনগুলো ক্ষমাপ্রার্থনা ও অনুশোচনার বদলে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর দলের সদস্যরা খুন করেছে নতুন প্রজন্মের এ তরুণদের যারা শুধুমাত্র তাদের স্বাধীন মত প্রকাশ করেছিল।
তেমন একজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীকে দয়া প্রদর্শন করা হল, এ দয়া কি কোনোভাবে তার প্রাপ্য ছিল? লাখ লাখ মানুষের প্রাণনাশ, কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রম যে লোকটির কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে ঘটে গেছে তার এই শাস্তি কী করে হয়? স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে, তার প্রতি এ দয়াপ্রদর্শন?
বিদ্রূপের মতোই শোনাল যখন বলা হল, বাকি জীবন তাকে কারাগারে কাটাতে হবে। সে কথা সত্য হবে কিনা জানি না, নাকি ফুলের মালায় বরণ করে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হবে সে প্রশ্নও এখন অজানা। কারাগারে থাকতে গেলেও এদেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় তাকে মহাসমাদরে প্রতিপালন করতে হবে রাষ্ট্রের। বড় দুর্ভাগ্য আমাদের!
এ সময় ক্রমে মনে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম কর্নেল আবু তাহেরর কথা। জিয়াউর রহমান তার প্রাণরক্ষাকারী কর্নেল তাহের, মুক্তিযুদ্ধে যিনি পা হারিয়েছেন সে মানুষটিকে গোপন বিচারের প্রহসন করে রায় ঘোষণার ৭২ ঘন্টার মধ্যে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছিল। তাহের ক্ষমাপ্রার্থনা করেননি, কিন্তু তার পরিবারের পক্ষ থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার আবেদন করা হয়েছিল। সে আবেদনে সাড়া দেননি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মো. সায়েম।
‘বঙ্গভবনে ৫ বছর’ শিরোনামের বইটিতে সাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার জানিয়েছেন বিচারপতি সায়েমের ইচ্ছে ছিল ফাঁসির রায়কে যাবজ্জীবনে রুপান্তর, কিন্তু জিয়াউর রহমানের চাপের কারণে তিনি নতি স্বীকার করেন। তাহেরের ফাঁসি ছিল ঠাণ্ডামাথার খুন। গত ২০ মে মহামান্য হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ বিচারিক রায়ে তাহেরকে একজন শহীদ এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমিক হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন।
মনের পর্দায় নানা কথা ভেসে ওঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাঁচ আসনের সংসদ সদস্য খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা শাহ জিকরুল আহমেদ বলছিলেন একাত্তরের বিজয়লগ্নের কথা। ৮ ডিসেম্বরে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত হলেও গোলাম আযমের জন্মস্থান নবীনগর মুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। জিকরুল আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করেন পঁয়ত্রিশ জন রাজাকারকে। সেখানে ব্যাংকারে পাওয়া গেল পাঁচজন বিবস্ত্র বাঙালি নারীকে। তারা অর্ধমৃত। আরও জানা গেল, এক মাস আগে নবীনগরের শ্রীরামপুর গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা আঠারো জন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে।
এর আগে ১০ অক্টোবর তারিখে গোলাম আযমের পার্শবর্তী খাড়গড় গ্রামে প্রায় পাঁচশ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে হানাদার বাহিনী ও দালাল রাজাকাররা। সে গ্রামটি ছিল দুর্গম অঞ্চলে। তাই আশপাশ থেকে জীবন বাঁচাতে খাড়গড়ে আশ্রয় নিয়েছিল নিরস্ত্র মানুষ। রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল এবং গ্রামটি ঘিরে ফেলেছিল। ওই হত্যাকাণ্ডের পরে মৃতদেহগুলো পুঁতে রাখে বিভিন্ন গণকবরে। নিহতদের মধ্যে ৪৬ জনকে শনাক্ত করে কবর দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। নবীনগরে ৬টি গণকবর পাওয়া যায়।
গোলাম আযমের প্রতিনিধি ইব্রাহিমপুর গ্রামের প্যারা মিয়া স্থানীয় শান্তি কমিটির সভাপতি। তার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল নবীনগর এলাকার রাজাকার বাহিনী। প্যারা মিয়ার গ্রামে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে পাওয়া গেল আরও একটি গণকবর। ১৬ ডিসেম্বর তারিখে মুক্তিবাহিনীর হাতে আটককৃত ৩৫ জন রাজাকারকে গণআদালতের বিচারে চূড়ান্ত শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যদি সেদিন নবীনগরে গোলাম আযম ধৃত হত তাহলে তার পরিণতি হত একই। ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড।
এ রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আছে যাতে বলা হয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামী যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ সংগঠনের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যেন নিয়োগ দেওয়া না হয় এবং এ সন্ত্রাসী সংগঠন বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা যেন নেওয়া হয় সে বিষয়ে সরকারকে অবহিত করা হয়েছে।
গোলাম আযমের এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষের আপিল করা কর্তব্য মনে করি। তবে তার চেয়েও বড় কথা হল, নতুন প্রজন্ম যে স্বপ্ন দেখেছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে, সে স্বপ্ন বৃথা যেতে পারে না। সে সব স্বপ্ন ফিরিয়ে আনা দরকার, যেমনটা এনেছিল গত ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর।
মো. আনোয়ার হোসেন
উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[জুলাই ১৫, ২০১৩ তারিখে bdnews24.com-এ প্রকাশিত]