‘অবাঞ্ছিত’

“হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান

অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘অবাঞ্ছিত’ শব্দটি এখন আমরা প্রায়ই শুনি। রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, গ্র্রাম, মহল্লা, শহর বা শহরতলীতে বিবদমান ব্যক্তি/গোষ্ঠী ‘অবাঞ্ছিত’ বাক্যবাণে একে অন্যকে কাবু করার চেষ্টা করেন। দূর অতীতে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে যখন জনবসতি এত ঘন ছিল না, শ্বাপদ সংকুল প্রকৃতি পরিবেষ্টিত ছিল জনপদ, তখন কাউকে সমাজচ্যুত করা হলে, জনবসতি বিছিন্ন হয়ে তাকে হয় অনাহারে বা হীংস্র পশুর আহার হয়ে করুণ মৃত্যুবরণ করতে হত। সেই থেকে কাউকে সমাজচ্যুত করতে হলে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হত। শিক্ষাদানের সর্বোচ্চ পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য এই শব্দের প্রয়োগ আগে তেমন শোনা যায়নি।

গত ১৯শে জুন, ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দেয়া হয়। সমিতি স্থীর করে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাশ নেয়া তারা পুনরায় শুরু করবেন যা তারা বন্ধ রেখেছিলেন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবীতে। একই সাথে পূর্বে ঘোষিত উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য চলমান আন্দোলনকে তীব্র করার লক্ষে উপাচার্যকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হয়। ‘অবাঞ্ছিত’ উপাচার্যকে পদত্যাগে বাধ্য না করা পর্যন্ত প্রশাসনিক কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে দেন তারা। তাঁদের সিদ্ধান্ত মতে ‘বর্তমান উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তাই সমিতির এই সভা উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের পদত্যাগ বা অপসারণের দাবী জানাচ্ছে এবং তাঁকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছে’। বিষয়টি নিয়ে আমি গভীরভাবে ভেবেছি। আত্মজিজ্ঞাসায় ব্রতি হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলা বিষয়ে সমিতির দাবীর সাথে কোনভাবেই একমত হতে পারেনি। সমাজে ‘অবাঞ্ছিত’ হিসেবে কাউকে ঘোষণা করার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি সম্পর্কে শুরুতে বলেছি। জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে আমাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হয়েছে হয়তো এ কারণে যে আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা শিক্ষক ছিলাম না। তাই এই ক্যাম্পাস আমাকে ত্যাজ্য করেছে। এমন ভাবনা আমাকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছে। শিক্ষক সমিতি শুধুমাত্র ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হয়নি। প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নকারী, স্বেচ্ছাচারি ও মিথ্যাবাদী উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত’- এই শিরোনামের ব্যানার তারা টানিয়ে দেন। এমনকি আমার বাসভবনের প্রবেশমুখের কাছে এমন একটি ব্যানার টানানো হয়। দড়ি ছিড়ে ব্যানারটি নিচে পড়ে যায় এক সময়। আমার স্ত্রী তা দেখে বাসার কর্মচারীদের দিয়ে ব্যানারটি পুনরায় সেখানে টানিয়ে দেন। এটা তিনি করেন এজন্য যে আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা যেন ভুল না বোঝেন। উপাচার্যের নির্দেশে ব্যানারটি খুলে ফেলার চেষ্টা হয়েছে এমন অপবাদ যেন তারা না দেন। কিন্তু গভীর বেদনায় স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পুত্রবধুকে নিয়ে ব্যানারের অমানবিক এবং অশিষ্ট কথাগুলো আমাদের পড়ে যেতে হয়েছে।

এমন অনেক সময় গেছে যখন ভেবেছি, যথেষ্ট হয়েছে। পদত্যাগ করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাই। তখনই মনে হয়েছে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, ব্যাপক শিক্ষকমণ্ডলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা। তারাতো আমাকে একান্ত আপনজন হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং এক বছরের বেশি সময় ধরে আমাকে পরম যতেœ আগলে রেখেছেন। আরও মনে পড়লো, গত ১২ই ফেব্র“য়ারী, ২০১৩ তারিখ রাতে যখন আমি ছুটিতে ক্যাম্পাসের বাইরে, প্রো-উপাচার্য উপাচার্যের দায়িত্বে আছেন, সেই সময় অসুস্থ্য হয়ে একজন ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের বাড়ী ও আমার বাসভবনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। সে রাতে বাসায় আমার স্ত্রী সম্পূর্ণ একা ছিলেন। আক্রমনকারীরা রান্না ঘরের এগজস্ট ফ্যান ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। দোতলার লোহার গেইট ভাঙ্গতে পারেনি বলে আমার স্ত্রী রক্ষা পান। অবাক বিষ্ময়ের কথা সে ঘটনায় শিক্ষক সমিতি আমার পদত্যাগ দাবী করে বসলেন। আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলাম। এরপরই এক অবিষ্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অগণিত শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ আমকে পদত্যাগ না করার আন্তরিক অনুরোধ করেছিলেন শুধু নয়, পদত্যাগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য আমাকে সাড়ে সাত ঘন্টা উপাচার্যের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন। সেই পরিস্থিতিতে আমি আমার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হই। এরপর গত ৬ই এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে একজন ছাত্র কর্তৃক শিক্ষকের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণের ঘটনায় সিন্ডিকেট কর্তৃক ছাত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা যথাযথ হয়নি প্রধানত এই অভিযোগ এবং এর সাথে আরও দুইটি অভিযোগ – প্রক্টরিয়াল বডি পুনর্গঠন ও গত বছরের ১লা ও ২রা আগস্টে গভীর রাতে মীর মশাররফ হোসেন হোসেন হলে পুলিশের প্রবেশ, ছাত্রদের সাথে সংঘর্ষ এবং ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাংচুর ইত্যাদি বিষয়ে তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবীতে শিক্ষক সমিতি পুনরায় আমার পদত্যাগ চেয়ে বসেন। এমনকি ২৪ ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগ করার আলটিমেটাম দেন তারা। সেসব দাবী বাস্তবায়নের পর আরও নতুন নতুন অভিযোগ উত্থাপন করে সমিতি। প্রতিটি অভিযোগ সম্পর্কে প্রশাসনের গৃহীত ব্যবস্থা সমিতিকে জানানোর পরও সমিতি আমার পদত্যাগের আন্দোলন চালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাশ নেয়া বন্ধ করে দেন আন্দোলনকারী শিক্ষকগণ। ২৪ ঘন্টার আলটিমেটাম পেরিয়ে যায়। গ্রীষ্মের ছুটি চলে আসে। শিক্ষার্থী ও ব্যাপক শিক্ষকগণ ক্লাশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে। আমি শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দকে অনুযোগ করে বলেছি, আপনারা কেন উপাচার্যের পদত্যাগের মত চূড়ান্ত নেন, যা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা যায় না। কথায় কথায় উপাচার্যের পদত্যাগ চাওয়াতো বড়ই অবাস্তব এবং কার্যত হটকারী সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।

সব শেষে গত ০৮ই জুলাই ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত শিক্ষক সমিতির জরুরি সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত পাঁচ দিন পর আমাকে জানানো হয়েছে। সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবীতে অবরোধসহ সকল কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ মহামান্য আচার্যের বরাবরে পত্র মারফত প্রেরণ করা হবে।

শিক্ষক সমিতির কিছু সংখ্যক শিক্ষকের দাবী অনুযায়ী আমি পদত্যাগ করতে পারতাম। কিন্তু তাঁরা যেসব অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে করেছেন এবং তার জন্য জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে আমাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছেন তা নিরসন না হওয়া পর্যন্ত আমি পদত্যাগ করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার পরিবারের পূর্ণ সমর্থন তাতে আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন সংকটকালে মহামান্য চ্যান্সেলর এবং বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমান আমাকে চার বছরের জন্য উপাচার্যের দায়িত্বভার অর্পণ করেছিলেন। আমি দুই মাসের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুযায়ী সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। গত বছরের ২০শে মে তারিখ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ঢাকায় আমাদের থাকার কোন বাড়ী নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লাটটিও আমি ছেড়ে দিয়েছি এক বছর আগে। কারণ তার ভাড়া হিসেবে আমাকে বাড়তি পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দিতে হত। তা বহন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। আমার স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধু ঢাকায় চাকুরী করে। ঢাকায় থাকার জায়গা না থাকায় তাদেরকেও জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে থাকতে হচ্ছে। প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে ঢাকায়। আমার বয়স ৬৪ বছর। যেসব অভিযোগ কিছু সংখ্যক শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে করেছেন, তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্বে আমার এই জীবনে কেউ করতে পারেননি। সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আমাকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে। সঠিক আয়কর প্রদান করি কিনা – তা থেকে শুরু করে আমাদের কি সম্পদ আছে, তা তন্ন তন্ন করে তারা খুঁজেছে। আমাকে নত করতে পারেনি। সততা, নীতি নিষ্ঠা এবং সৎ সাহস – এ ছাড়া আমার আর কিছু নেই। কেউ তা হরণ করতে পারে না। আমি তা হতে দেব না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় চ্যান্সেলর, সনির্বন্ধ আবেদন আপনার কাছে। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ গভীরে খতিয়ে দেখুন। যে কলঙ্ক তিলক আমার উপর লেপন করা হয়েছে, তা মুছে না ফেলেতো আমি এই ক্যাম্পাস ত্যাগ করবো না।

মো. আনোয়ার হোসেন

উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[১৭ই জুলাই ২০১৩ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত]

Image