M Anwar Hossain

A place to share my thoughts and views

Tag: উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আন্দোলন প্রসঙ্গে উপাচার্যের সংবাদ সম্মেলন – ০৩/০৭/২০১৩

সমাগত সুধীবৃন্দ,

প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,

আপনারা আমার আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের খবর সংগ্রহের জন্য আপনারা দীর্ঘ সময় ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। আপনাদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের কারণেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অগ্রগতি ও একাডেমিক উৎকর্ষের কথা দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 

মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক চার বছরের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব থেকে বিরাজমান জটিলতা ও সংকট নিরসনে মনোযোগী হই। একই সঙ্গে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুযায়ী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের আয়োজন করি। সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার পর মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাকে চার বছরের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে দ্বিতীয়বার নিয়োগ প্রদান করেন। একজন নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে আমি সকলকে নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করি। আমি অনুভব করি যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তাকে কাজে লাগানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছি। দিনের পর দিন আমি সবার সাথে মতবিনিময় করে চলেছি এবং তার ভিত্তিতে আমরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উন্নয়ন ও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করিনি। শিক্ষক সমিতি যখনই কোন দাবী-দাওয়া উত্থাপন করেছে, আমরা তা তড়িৎ গতিতে বাস্তবায়ন করেছি। উদাহরণ স্বরূপ শিক্ষকদের বিভিন্ন পারিতোষিক বৃদ্ধির কথা বলা যায়। এছাড়াও গত ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষকগণ যে দিনরাত পরিশ্রম করে অত্যন্ত সফলতার সাথে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করেছেন, সে কথা মনে রেখে পূর্ববর্তী ভর্তি পরীক্ষার তুলনায় শিক্ষকদের ও সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মানী প্রায় ৩০ ভাগ বৃদ্ধি করেছি। বিনয়ের সঙ্গে উল্লেখ করছি যে, ভর্তি পরীক্ষার আয় থেকে আমি নিজে কোন সম্মানী গ্রহণ করিনি।

আমি সর্বতোভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের স্বার্থকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছি। তবুও বিভিন্ন সময়ে আমি নানা অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছি। আমার সদিচ্ছা ও বিনয়কে নানাভাবে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আমি মৌখিক ও লিখিতভাবে উত্তর প্রদানও করেছি। কিন্তু শিক্ষক সমিতি উপর্যুপরি নতুন নতুন অভিযোগ উত্থাপন করে আমার পদত্যাগ দাবী করছেন। সম্প্রতি শিক্ষক সমিতির ব্যানারে আন্দোলনের নামে উপাচার্য কার্যালয় তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেমে গেছে। এ থেকে নানা রকম জটিলতা ও সংকট তৈরি হচ্ছে। আমি এইসব সংকট নিরসনে নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছি। আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের জন্য আমি শিক্ষক সমিতিকে বার বার চিঠিও দিয়েছি। আমি এখনো মনে করি আলোচনার মাধ্যমে বিরাজমান সংকট নিরসন করা সম্ভব।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি যে মূল ৪টি দাবী আদায় না হলে আমার পদত্যাগ দাবী করেছিলেন, তার প্রতিটি দাবী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সে সম্পর্কে ইতোপূর্বে আমি লিখিতভাবে সমিতিকে জানিয়েছি। এরপর গত ১৯শে জুন, ২০১৩ তারিখে আরো নতুন নতুন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। শিক্ষক সমিতির মূল ৪টি দাবী ও নতুন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি তা আপনাদের মাধ্যমে আমি পুনরায় দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছি:

১) গত ৬ই এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে একজন ছাত্র কর্তৃক শিক্ষকের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণের বিষয়ে তদন্ত ও সুপারিশ প্রদানের জন্য সিন্ডিকেট কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে জরুরী ডিসিপ্লিনারি বোর্ডের সভায় অভিযুক্ত ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তির সর্বসম্মত সুপারিশ অনুযায়ী সিন্ডিকেটের জরুরী সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক অভিযুক্ত ছাত্রকে শাস্তি প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য সিন্ডিকেটের একজন সম্মানিত সদস্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বেই সভা ত্যাগ করেন। আরো উল্লেখ্য যে, শাস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তদন্ত কমিটি, ডিসিপ্লিনারি বোর্ড এবং সিন্ডিকেটের সম্মানিত সদস্যগণ যা স্থির করেছেন তাই গ্রহণ করা হয়েছে।

২) গত ১২ই ফেব্র“য়ারি, ২০১৩ তারিখে চিকিৎসা অবহেলায় একজন ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে উত্থাপিত অভিযোগ এবং তা থেকে সৃষ্ট ব্যাপক ভাংচুরের ঘটনায় যে দু’জন শিক্ষকের গাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাঁদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে। উল্লিখিত ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং উচ্ছৃংখল কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িতদের সনাক্ত করা এবং যথাযোগ্য শাস্তির সুপারিশ করার জন্য সিন্ডিকেট কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যেই ১৫টি সভায় মিলিত হয়েছেন এবং দ্রুত তদন্ত কাজ শেষ করে রিপোর্ট প্রদান করবেন বলে জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) এর সভাপতিত্বে উক্ত কমিটিতে শিক্ষক সমিতির সভাপতিসহ সর্বমোট ১৩জন সদস্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর জরুরী ডিসিপ্লিনারি বোর্ড ও সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করে যথাবিহিত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে উল্লেখ্য, শিক্ষক সমিতির অবরোধের কারণে বর্তমানে তদন্তের কাজ থেমে আছে। 

৩) প্রক্টরিয়াল বডি পুনর্গঠন করা হয়েছে। নবনিয়োজিত প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরদের সমন্বয়ে পুনর্গঠিত প্রক্টরিয়াল বডি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

৪) গত পহেলা ও ২রা আগস্ট ২০১২ তারিখে মীর মশাররফ হোসেন হলে গভীর রাতে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে পুলিশের প্রবেশ ও একজন অভিযুক্ত ছাত্রকে গ্রেফতারের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক ভাংচুর, ঢাকা আরিচা-মহাসড়ক ১৬ ঘন্টা অবরোধ করে রাখা – ইত্যাদি বিষয়ে তদন্ত করবার জন্য সিন্ডিকেট কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ডিসিপ্লিনারি বোর্ডের সর্বসম্মত সুপারিশ অনুযায়ী জরুরী সিন্ডিকেট সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৩৩জন অভিযুক্ত ছাত্রকে শাস্তি উল্লেখ করে ‘কেন তা প্রদান করা হবে না’ তার কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।

উপরোক্ত মূল ৪টি দাবী বাস্তবায়নের পরও শিক্ষক সমিতি নতুন করে আরো অভিযোগ উত্থাপিত করেছেন। এ সব অভিযোগ বিষয়ে আমার বক্তব্য নিম্নরূপ:

* বর্তমান কর্তৃপক্ষের সময়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অযোগ্য বা কম মেধাবী কাউকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। কোন বিভাগে অযোগ্য বা কম মেধাবী কাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা জানাতে শিক্ষক সমিতিকে বিনীত অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য, আমার সময়কালে শিক্ষক নিয়োগে ‘ভিন্ন মত’ (নোট অব ডিসেন্ট) প্রদান করা হয়নি।

* কর্তৃপক্ষ ভর্তি পরীক্ষার নীতিমালা লংঘন করে এবং অমুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় অন্তর্ভুক্ত করে ভর্তির অনুমতি দেয়নি। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ২জন প্রার্থীকে – যথাক্রমে একজনের পিতা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রিক্সা চালিয়ে তার মেয়েটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং অন্যজনের মা, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিঠা বিক্রি করে বহু কষ্টে তার ছেলের লেখা-পড়ার খরচ যুগিয়েছেন। এই দু’জনকে বিশেষ মানবিক বিবেচনায় ভর্তির জন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সনির্বন্ধ অনুরোধ বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ভর্তির অনুমতি দেয়া হয়। ১৪-০৪-২০১৩ তারিখে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের শূন্য আসনের তালিকার সাথে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়। তালিকার শিরোনাম ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটার শূন্য আসন এবং কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটির ১৫তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রদত্ত আসন’। তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তি হয়নি। তারা ভর্তি হয়েছে ‘কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটির ১৫তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রদত্ত আসনে’। এই দু’জন শিক্ষার্থী – দুস্থ নিঃস্ব দরিদ্রের সন্তান বলেই কি এতো কঠোর সমালোচনার মধ্যে পড়েছি?

* আমি পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌজন্যবোধ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো শিক্ষকের সঙ্গে আমি কোনরূপ অসৌজন্যমূলক আচরণ করিনি। কাউকে মেয়াদ শেষ হবার পূর্বে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেইনি। বরং আমার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের কেউ কেউ পদত্যাগ করার পরও প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। তাঁরা আমার অনুরোধ রক্ষা করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

* আপনাদের অবগতির জন্য জানাই, আমার দায়িত্বভার গ্রহণের পূর্ব থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞান, গণিত ও দর্শন বিভাগে অচলাবস্থার কারণে একাডেমিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছিল তা আমার সক্রিয় উদ্যোগে সম্মিলিত চেষ্টায় দূর করা সম্ভব হয়েছে।

* আমি একাডেমিক কর্মকাণ্ডকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেয়ার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তবে একথাও সত্যি যে, বিভিন্ন সময়ে সৃষ্ট সংকট নিরসনে আমাকে দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ফলে একাডেমিক অগ্রগতিতে আরো অধিক সময় দেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি।

* সিন্ডিকেট সভায় কখনো কোনো সম্মানিত সিন্ডিকেট সদস্যের সঙ্গে আমার অসৌজন্যমূলক আচরণের ঘটনা ঘটেনি। বরং পরম ধৈর্যে সম্মানিত সদস্যদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছি। তাই আমার সময়কালে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ‘ভিন্ন মত’ (নোট অব ডিসেন্ট) লিপিবদ্ধ করার ঘটনা অত্যন্ত নগণ্য।

* বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে আমার অশিষ্ট মন্তব্য করার অভিযোগ সঠিক নয়। আমি লিখিত কোনো বক্তব্যে, কোনো সভায় কিংবা কোনো মিডিয়ার সামনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমন কোনো বক্তব্য প্রদান করিনি। বরং নামে, বেনামে, সংগঠনের পরিচয়ে এমনকি সামনা সামনি আমার বিরুদ্ধে অশিষ্ট বাক্য প্রয়োগ করা হয়েছে। তারপরও শিক্ষার্থীদের কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়কে সচল রাখার কথা বিবেচনা করে আমি সেইসব সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছি।

* আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূদৃশ্য নষ্ট করেছি এই অভিযোগ আমাকে মর্মাহত করে। উপাচার্যের দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরম নৈসর্গিক দৃশ্যকে আরো নয়নাভিরাম করার জন্য সকলের পরামর্শ মত নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছি। গত ৪২ বছরে এই প্রথম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ রক্ষা বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য প্রথিতযশা পরিবেশ সচেতন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যেই খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। এধরনের উদ্যোগ এবং কর্মসূচি গ্রহণের ফলেই বিপুল সংখ্যায় পরিযায়ী পাখিরা লেকগুলোত ফিরে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলো ঐতিহ্যবাহী লাল শাপলায় আবার ভরে উঠেছে।

* কাবিখা প্রকল্পের আওতায় ৭টি লেক/জলাশয় পুন:খননের জন্য স্বনামধন্য শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ৭টি কমিটির নিরন্তর পরিকল্পনা ও নিরলস শ্রমের ফলে ইতোমধ্যেই প্রকল্পসমূহের কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে।

* এছাড়া হরিজন, ঝাড়–দার এবং বাগান মালীদের সমিতির তত্ত্বাবধানে মৎস্য অধিদপ্তরের অর্থায়নে তিনটি পুকুর পুন:খননের কাজও দ্রুত সমাপ্তির পথে। মাটি কাটার পাশাপাশি এসব প্রকল্পের সাথে বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিও যুক্ত আছে। এসব প্রকল্পে দূষিত পানি পরিশুদ্ধ করে জলাশয়ে নির্গমনের ব্যবস্থার মাধ্যমে পানির মান সংরক্ষণ; দৃষ্টিনন্দন ফুলের গাছ রোপন করা এবং বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় মাছ, পাখী ও বন্য প্রজাতির অভয়াশ্রম হিসেবে তাদের গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশের খ্যাতিমান পরিবেশ সচেতন বিশেষজ্ঞগণ দ্বারা এসব প্রকল্প প্রশংসিত হয়েছে।

* কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণে গত ৯ই জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় গৃহীত পদক্ষেপের কারণে ক্যাম্পাস বর্তমানে অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছ্ন্ন।

* আমার দায়িত্বভার গ্রহণের পর গত ১ বছরে (সরকারের শেষ বছরে অর্থ সংকটের সময়ে) বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বাধিক ৩৪ কোটি টাকা সরকারি বরাদ্দ আনা সম্ভব হয়েছে।

* বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৪২ বছরে সীমানা প্রাচীর তৈরি হয়নি। আমার দায়িত্বভার গ্রহণের পর ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

* ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ যাবত একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল সেন্টার ছিল না। সে কারণে ব্যাপক ছাত্র অসন্তোষ ও সম্পদ ধ্বংসের ঘটনাও ঘটেছে। আমার সক্রিয় চেষ্টায় ইতোমধ্যেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের দীর্ঘদিনের লালিত প্রত্যাশা অনুযায়ী ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেডিকেল সেন্টারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।

* মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা রক্ষার্থে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মন্দির, বৌদ্ধ বিহার ও গির্জা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে উল্লেখ্য যে, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর যখন বেদনাদায়ক আঘাত হানা হলো তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমাবেশ ও সেমিনার করেছি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলের সমন্বিত আর্থিক সহযোগিতা ও ভালোবাসা নিয়ে আমরা ছুটে গিয়েছি রামু, উঁখিয়া ও টেকনাফে পীড়িতদের পাশে।

* হলগুলোতে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সদস্য – যাদের ছাত্রত্ব আছে এমন সকলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে। ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে রক্তপাত কিংবা গুরুতর হানাহানি ঘটেনি এই সময়ে। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে অব্যাহতভাবে মতবিনিময়ের ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। প্রশাসনের সক্রিয় উদ্যোগে এবং শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনসমূহের সহযোগিতায় আবাসিক হল থেকে অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব হয়েছে এবং ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের নিরাপদ বোধ করছে।

* উপাচার্যের পদত্যাগের ঘোষণা এবং প্রত্যাহার সম্পর্কে আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, আমি শিক্ষক সমিতির দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলাম। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এক সংকটময় মুহুর্তে আমাকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব অর্পণ করেন। পরবর্তী সময়ে আমি সিনেটে নির্বাচিত হয়ে ‘নির্বাচিত উপাচার্য’ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। সবাইকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নেয়ার যে প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলাম, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অগণিত ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী আমাকে পদত্যাগ না করে দায়িত্ব পালনের আন্তরিক অনুরোধ করেছিলেন শুধু নয়, পদত্যাগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য আমাকে সাড়ে সাত ঘন্টা উপাচার্যের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন। সেই পরিস্থিতিতে আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হই।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,

অযৌক্তিকভাবে প্রশাসন ভবন তালা দিয়ে অবরোধ করে রাখায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে, যেমন:

* গত ২০-০৬-২০১৩ তারিখে নির্ধারিত সিন্ডিকেট সভা হতে দেয়া হয়নি। ফলে শিক্ষকদের পদোন্নতিসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

* গত ২১-০৬-২০১৩ তারিখে আয়োজিত বার্ষিক সিনেট সভা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরের সম্পূরক বাজেট এবং ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরের মূল বাজেট অনুমোদন করা সম্ভব হয়নি। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ১লা জুলাই, ২০১৩ থেকে আর্থিক জটিলতার সৃষ্টি হবে। এ সভা না হওয়ায় কর্মকর্তাদের চাকরির বয়সসীমা ৬০ থেকে ৬২ বছর করার প্রস্তাব অমিমাংসিত অবস্থায় রয়ে গেছে। এছাড়া ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষে বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদন করা সম্ভব হয়নি। সিনেট সভা অনুষ্ঠিত হতে না দিয়ে শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩ এর গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এবং দেশবাসীর কাছে এ এক অশনি সংকেত।

* প্রশাসন ভবন অবরোধের কারণে গত ২৬-০৬-২০১৩ তারিখে আয়োজিত বোর্ড অব এ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং শিক্ষা পর্ষদের সভার কর্মপত্র যথাসময়ে প্রেরণ করা সম্ভব না হওয়ায় এবং ভবন তালাবদ্ধ করে রাখায় উক্ত সভাটি অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এতে একাডেমিক বিষয়ে বিশেষ করে শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্থগিত রয়েছে।

* ২৭-০৬-২০১৩ তারিখে নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন পর্ষদের সভাটি আয়োজন করতে দেয়া হয়নি বিধায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন এবং জীববিজ্ঞান অনুষদ ভবনের বর্ধিতাংশ নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ ব্যাহত ও বিলম্ব হবে। উল্লেখ্য, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে অবস্থিত বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও অন্য দু’টি বিভাগকে দ্রুততম সময়ে জীববিজ্ঞান অনুষদ ভবনের বর্ধিতাংশে স্থানান্তরের কথা ছিল।

* ২৭-০৬-২০১৩ তারিখে কর্মচারীদের একটি পদোন্নতি সংক্রান্ত নির্বাচন কমিটির সভা হতে দেয়া হয়নি। ফলে এইসব অবসরগামী কর্মচারীরা ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

* এছাড়াও আন্দোলনের কর্মসূচির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরনের নিয়োগ/পদোন্নতির সভা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছি।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ক্লাসে ফিরে যাওয়ায় আমি তাদের সাধুবাদ জানাই। আমি আশা করি, শিক্ষক সমিতি অনতিবিলম্বে প্রশাসনিক ভবন অবরোধ কর্মসূচিও প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক বিধিবিধান রক্ষা করবেন এবং স্বাভাবিক একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম নিরুপদ্রব রাখতে অবদান রাখবেন। সব শেষে আমি ঐকান্তিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আলোচনার মাধ্যমেই সকল প্রকার সংকট নিরসন সম্ভব।

অধ্যাপক মোঃ আনোয়ার হোসেন

উপাচার্য

 

 

 

এ রায় মেনে নেওয়া যায় না

দীর্ঘ ৪২ বছর পর, বহুপ্রত্যাশিত গোলাম আযমের বিচারের রায় ঘোষিত হল। আজ সকাল ১০.৫২ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ এর মহামান্য চেয়ারম্যান রায়ের প্রারম্ভিক বক্তব্য শুরু করলেন। তিনি জানালেন, ২৪৩ পৃষ্ঠার রায়ের মধ্যে ৭৫ পৃষ্ঠা পড়বেন। ১১ টা ০২ মিনিটে মূল রায় পড়া শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। টানা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তিনি পাঠ করে ফেলেন মূল ৫টি অভিযোগ, এ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে হত্যার পঞ্চম অভিযোগটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যোগসাজসের। সাড়ে ১২ টার পরে ট্রাইব্যুনালের ২য় বিচারক জাহাঙ্গীর হোসেন রায়ের দ্বিতীয় অংশ পাঠ করলেন। ট্রাইব্যুনালের মহামান্য চেয়ারম্যান ১টা ০৭ মিনিট থেকে রায়ের মূল অংশ পড়তে শুরু করলেন। একটানা একটা ৩৭ মিনিট পর্যন্ত একে একে পাঁচটি অভিযোগের সপক্ষে এবং বিপক্ষের মুল যুক্তিগুলো তিনি তুলে ধরলেন। খুব স্পষ্টভাবেই তিনি জানালেন, এই গোলাম আযম ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর এবং কার্যত তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের অঘোষিত শাসক হিসেবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন।

২২ নভেম্বর ১৯৭১ এ পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যান এ ব্যক্তি। কিন্তু এর পরদিন ২৩ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তার পরিকল্পনা ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত বিভিন্ন অক্সিলারি ফোর্স, যেমন রাজাকার, আলবদর, আল শামস সদস্যদের অটোমেটিক ওয়েপন এবং আরও উন্নত অস্ত্র-শস্ত্র সরবরাহ করার অনুরোধ করেন।

মহামান্য বিচারক বলছিলেন, ‘ডকট্রিন অব সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’র কথা। তিনি জানালেন, বিচারে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে গোলাম আযম একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন। তার পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল-শামস নামের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীর সফল কৃতকর্মের দায়ভার তার ওপরেই বর্তায়। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে যে পঞ্চম অভিযোগ সেটি ছিল শিরু মিয়াসহ আরও তিনজন হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততা যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

প্রমাণিত এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি মাত্র সাজা ‘ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট’। ঘড়ির কাঁটা ১টা ৩৭ মিনিট। বিচারক জানালেন তিনি এবার মূল রায়টি পড়বেন। আদালতের ফিসফাস শব্দ থেমে গেছে। পিনপতন নিরবতা। আমার পাশে বসা মুনতাসীর মামুন ইতোমধ্যেই করমর্দন করেছেন আমার সঙ্গে। হাস্যোজ্জ্বল মুখ চারদিক। বিজয়ের চিহ্ন সবার অবয়বে।

১ টা ৩৭ থেকে ১টা ৪০ এ তিন মিনিটে মূল রায়টি পড়লেন বিচারক। ১টি ২টি করে ৫টি সাজার জন্য ঘোষণা করলেন বিভিন্ন মেয়াদী সাজা। সর্বমোট ৯০ বছর। বিচারক বললেন, সর্বোচ্চ সাজা প্রদানই ছিল যথাযথ কিন্তু আসামি বিচারকার্য শুরু করার পর থেকে বয়সের ভারে এবং অসুস্থতার কারণে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৯১ বছর বয়স, শুধুমাত্র সে বিবেচনায় সর্বোচ্চ সাজার বদলে ৯০ বছর সাজা দেওয়া হল।

মিনিট দুয়েক আগে আদালতের যে মুখগুলো ছিল হাস্যোজ্জ্বল সেখানে বিষাদের ছায়া। এ রায় কি পাওনা ছিল! এর জন্যই কি দীর্ঘ অপেক্ষা! এ নরাধম লোকটি তার এ দীর্ঘ জীবনে কোনোদিন অনুশোচনা করেনি, তার পরিবারের সদস্যরাও অনুশোচনা করেনি। তার পুত্র সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত ব্রিগেডিয়ার অনুশোচনার বদলে উল্টো ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে; তার দল জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠনগুলো ক্ষমাপ্রার্থনা ও অনুশোচনার বদলে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর দলের সদস্যরা খুন করেছে নতুন প্রজন্মের এ তরুণদের যারা শুধুমাত্র তাদের স্বাধীন মত প্রকাশ করেছিল।

তেমন একজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীকে দয়া প্রদর্শন করা হল, এ দয়া কি কোনোভাবে তার প্রাপ্য ছিল? লাখ লাখ মানুষের প্রাণনাশ, কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রম যে লোকটির কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে ঘটে গেছে তার এই শাস্তি কী করে হয়? স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে, তার প্রতি এ দয়াপ্রদর্শন?

বিদ্রূপের মতোই শোনাল যখন বলা হল, বাকি জীবন তাকে কারাগারে কাটাতে হবে। সে কথা সত্য হবে কিনা জানি না, নাকি ফুলের মালায় বরণ করে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হবে সে প্রশ্নও এখন অজানা। কারাগারে থাকতে গেলেও এদেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় তাকে মহাসমাদরে প্রতিপালন করতে হবে রাষ্ট্রের। বড় দুর্ভাগ্য আমাদের!

এ সময় ক্রমে মনে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম কর্নেল আবু তাহেরর কথা। জিয়াউর রহমান তার প্রাণরক্ষাকারী কর্নেল তাহের, মুক্তিযুদ্ধে যিনি পা হারিয়েছেন সে মানুষটিকে গোপন বিচারের প্রহসন করে রায় ঘোষণার ৭২ ঘন্টার মধ্যে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছিল। তাহের ক্ষমাপ্রার্থনা করেননি, কিন্তু তার পরিবারের পক্ষ থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার আবেদন করা হয়েছিল। সে আবেদনে সাড়া দেননি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মো. সায়েম।

‘বঙ্গভবনে ৫ বছর’ শিরোনামের বইটিতে সাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার জানিয়েছেন বিচারপতি সায়েমের ইচ্ছে ছিল ফাঁসির রায়কে যাবজ্জীবনে রুপান্তর, কিন্তু জিয়াউর রহমানের চাপের কারণে তিনি নতি স্বীকার করেন। তাহেরের ফাঁসি ছিল ঠাণ্ডামাথার খুন। গত ২০ মে মহামান্য হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ বিচারিক রায়ে তাহেরকে একজন শহীদ এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমিক হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন।

মনের পর্দায় নানা কথা ভেসে ওঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাঁচ আসনের সংসদ সদস্য খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা শাহ জিকরুল আহমেদ বলছিলেন একাত্তরের বিজয়লগ্নের কথা। ৮ ডিসেম্বরে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত হলেও গোলাম আযমের জন্মস্থান নবীনগর মুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। জিকরুল আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করেন পঁয়ত্রিশ জন রাজাকারকে। সেখানে ব্যাংকারে পাওয়া গেল পাঁচজন বিবস্ত্র বাঙালি নারীকে। তারা অর্ধমৃত। আরও জানা গেল, এক মাস আগে নবীনগরের শ্রীরামপুর গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা আঠারো জন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে।

এর আগে ১০ অক্টোবর তারিখে গোলাম আযমের পার্শবর্তী খাড়গড় গ্রামে প্রায় পাঁচশ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে হানাদার বাহিনী ও দালাল রাজাকাররা। সে গ্রামটি ছিল দুর্গম অঞ্চলে। তাই আশপাশ থেকে জীবন বাঁচাতে খাড়গড়ে আশ্রয় নিয়েছিল নিরস্ত্র মানুষ। রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল এবং গ্রামটি ঘিরে ফেলেছিল। ওই হত্যাকাণ্ডের পরে মৃতদেহগুলো পুঁতে রাখে বিভিন্ন গণকবরে। নিহতদের মধ্যে ৪৬ জনকে শনাক্ত করে কবর দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। নবীনগরে ৬টি গণকবর পাওয়া যায়।

গোলাম আযমের প্রতিনিধি ইব্রাহিমপুর গ্রামের প্যারা মিয়া স্থানীয় শান্তি কমিটির সভাপতি। তার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল নবীনগর এলাকার রাজাকার বাহিনী। প্যারা মিয়ার গ্রামে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে পাওয়া গেল আরও একটি গণকবর। ১৬ ডিসেম্বর তারিখে মুক্তিবাহিনীর হাতে আটককৃত ৩৫ জন রাজাকারকে গণআদালতের বিচারে চূড়ান্ত শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যদি সেদিন নবীনগরে গোলাম আযম ধৃত হত তাহলে তার পরিণতি হত একই। ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড।

এ রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আছে যাতে বলা হয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামী যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ সংগঠনের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যেন নিয়োগ দেওয়া না হয় এবং এ সন্ত্রাসী সংগঠন বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা যেন নেওয়া হয় সে বিষয়ে সরকারকে অবহিত করা হয়েছে।

গোলাম আযমের এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষের আপিল করা কর্তব্য মনে করি। তবে তার চেয়েও বড় কথা হল, নতুন প্রজন্ম যে স্বপ্ন দেখেছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে, সে স্বপ্ন বৃথা যেতে পারে না। সে সব স্বপ্ন ফিরিয়ে আনা দরকার, যেমনটা এনেছিল গত ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর।

মো. আনোয়ার হোসেন

উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[জুলাই ১৫, ২০১৩ তারিখে bdnews24.com-এ প্রকাশিত]

‘অবাঞ্ছিত’

“হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান

অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘অবাঞ্ছিত’ শব্দটি এখন আমরা প্রায়ই শুনি। রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, গ্র্রাম, মহল্লা, শহর বা শহরতলীতে বিবদমান ব্যক্তি/গোষ্ঠী ‘অবাঞ্ছিত’ বাক্যবাণে একে অন্যকে কাবু করার চেষ্টা করেন। দূর অতীতে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে যখন জনবসতি এত ঘন ছিল না, শ্বাপদ সংকুল প্রকৃতি পরিবেষ্টিত ছিল জনপদ, তখন কাউকে সমাজচ্যুত করা হলে, জনবসতি বিছিন্ন হয়ে তাকে হয় অনাহারে বা হীংস্র পশুর আহার হয়ে করুণ মৃত্যুবরণ করতে হত। সেই থেকে কাউকে সমাজচ্যুত করতে হলে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হত। শিক্ষাদানের সর্বোচ্চ পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য এই শব্দের প্রয়োগ আগে তেমন শোনা যায়নি।

গত ১৯শে জুন, ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দেয়া হয়। সমিতি স্থীর করে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাশ নেয়া তারা পুনরায় শুরু করবেন যা তারা বন্ধ রেখেছিলেন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবীতে। একই সাথে পূর্বে ঘোষিত উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য চলমান আন্দোলনকে তীব্র করার লক্ষে উপাচার্যকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হয়। ‘অবাঞ্ছিত’ উপাচার্যকে পদত্যাগে বাধ্য না করা পর্যন্ত প্রশাসনিক কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে দেন তারা। তাঁদের সিদ্ধান্ত মতে ‘বর্তমান উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তাই সমিতির এই সভা উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের পদত্যাগ বা অপসারণের দাবী জানাচ্ছে এবং তাঁকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছে’। বিষয়টি নিয়ে আমি গভীরভাবে ভেবেছি। আত্মজিজ্ঞাসায় ব্রতি হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলা বিষয়ে সমিতির দাবীর সাথে কোনভাবেই একমত হতে পারেনি। সমাজে ‘অবাঞ্ছিত’ হিসেবে কাউকে ঘোষণা করার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি সম্পর্কে শুরুতে বলেছি। জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে আমাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হয়েছে হয়তো এ কারণে যে আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা শিক্ষক ছিলাম না। তাই এই ক্যাম্পাস আমাকে ত্যাজ্য করেছে। এমন ভাবনা আমাকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছে। শিক্ষক সমিতি শুধুমাত্র ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হয়নি। প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নকারী, স্বেচ্ছাচারি ও মিথ্যাবাদী উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত’- এই শিরোনামের ব্যানার তারা টানিয়ে দেন। এমনকি আমার বাসভবনের প্রবেশমুখের কাছে এমন একটি ব্যানার টানানো হয়। দড়ি ছিড়ে ব্যানারটি নিচে পড়ে যায় এক সময়। আমার স্ত্রী তা দেখে বাসার কর্মচারীদের দিয়ে ব্যানারটি পুনরায় সেখানে টানিয়ে দেন। এটা তিনি করেন এজন্য যে আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা যেন ভুল না বোঝেন। উপাচার্যের নির্দেশে ব্যানারটি খুলে ফেলার চেষ্টা হয়েছে এমন অপবাদ যেন তারা না দেন। কিন্তু গভীর বেদনায় স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পুত্রবধুকে নিয়ে ব্যানারের অমানবিক এবং অশিষ্ট কথাগুলো আমাদের পড়ে যেতে হয়েছে।

এমন অনেক সময় গেছে যখন ভেবেছি, যথেষ্ট হয়েছে। পদত্যাগ করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাই। তখনই মনে হয়েছে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, ব্যাপক শিক্ষকমণ্ডলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা। তারাতো আমাকে একান্ত আপনজন হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং এক বছরের বেশি সময় ধরে আমাকে পরম যতেœ আগলে রেখেছেন। আরও মনে পড়লো, গত ১২ই ফেব্র“য়ারী, ২০১৩ তারিখ রাতে যখন আমি ছুটিতে ক্যাম্পাসের বাইরে, প্রো-উপাচার্য উপাচার্যের দায়িত্বে আছেন, সেই সময় অসুস্থ্য হয়ে একজন ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের বাড়ী ও আমার বাসভবনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। সে রাতে বাসায় আমার স্ত্রী সম্পূর্ণ একা ছিলেন। আক্রমনকারীরা রান্না ঘরের এগজস্ট ফ্যান ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। দোতলার লোহার গেইট ভাঙ্গতে পারেনি বলে আমার স্ত্রী রক্ষা পান। অবাক বিষ্ময়ের কথা সে ঘটনায় শিক্ষক সমিতি আমার পদত্যাগ দাবী করে বসলেন। আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলাম। এরপরই এক অবিষ্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অগণিত শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ আমকে পদত্যাগ না করার আন্তরিক অনুরোধ করেছিলেন শুধু নয়, পদত্যাগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য আমাকে সাড়ে সাত ঘন্টা উপাচার্যের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন। সেই পরিস্থিতিতে আমি আমার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হই। এরপর গত ৬ই এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে একজন ছাত্র কর্তৃক শিক্ষকের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণের ঘটনায় সিন্ডিকেট কর্তৃক ছাত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা যথাযথ হয়নি প্রধানত এই অভিযোগ এবং এর সাথে আরও দুইটি অভিযোগ – প্রক্টরিয়াল বডি পুনর্গঠন ও গত বছরের ১লা ও ২রা আগস্টে গভীর রাতে মীর মশাররফ হোসেন হোসেন হলে পুলিশের প্রবেশ, ছাত্রদের সাথে সংঘর্ষ এবং ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাংচুর ইত্যাদি বিষয়ে তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবীতে শিক্ষক সমিতি পুনরায় আমার পদত্যাগ চেয়ে বসেন। এমনকি ২৪ ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগ করার আলটিমেটাম দেন তারা। সেসব দাবী বাস্তবায়নের পর আরও নতুন নতুন অভিযোগ উত্থাপন করে সমিতি। প্রতিটি অভিযোগ সম্পর্কে প্রশাসনের গৃহীত ব্যবস্থা সমিতিকে জানানোর পরও সমিতি আমার পদত্যাগের আন্দোলন চালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাশ নেয়া বন্ধ করে দেন আন্দোলনকারী শিক্ষকগণ। ২৪ ঘন্টার আলটিমেটাম পেরিয়ে যায়। গ্রীষ্মের ছুটি চলে আসে। শিক্ষার্থী ও ব্যাপক শিক্ষকগণ ক্লাশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে। আমি শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দকে অনুযোগ করে বলেছি, আপনারা কেন উপাচার্যের পদত্যাগের মত চূড়ান্ত নেন, যা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা যায় না। কথায় কথায় উপাচার্যের পদত্যাগ চাওয়াতো বড়ই অবাস্তব এবং কার্যত হটকারী সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।

সব শেষে গত ০৮ই জুলাই ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত শিক্ষক সমিতির জরুরি সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত পাঁচ দিন পর আমাকে জানানো হয়েছে। সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবীতে অবরোধসহ সকল কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ মহামান্য আচার্যের বরাবরে পত্র মারফত প্রেরণ করা হবে।

শিক্ষক সমিতির কিছু সংখ্যক শিক্ষকের দাবী অনুযায়ী আমি পদত্যাগ করতে পারতাম। কিন্তু তাঁরা যেসব অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে করেছেন এবং তার জন্য জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে আমাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছেন তা নিরসন না হওয়া পর্যন্ত আমি পদত্যাগ করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার পরিবারের পূর্ণ সমর্থন তাতে আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন সংকটকালে মহামান্য চ্যান্সেলর এবং বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমান আমাকে চার বছরের জন্য উপাচার্যের দায়িত্বভার অর্পণ করেছিলেন। আমি দুই মাসের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুযায়ী সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। গত বছরের ২০শে মে তারিখ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ঢাকায় আমাদের থাকার কোন বাড়ী নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লাটটিও আমি ছেড়ে দিয়েছি এক বছর আগে। কারণ তার ভাড়া হিসেবে আমাকে বাড়তি পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দিতে হত। তা বহন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। আমার স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধু ঢাকায় চাকুরী করে। ঢাকায় থাকার জায়গা না থাকায় তাদেরকেও জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে থাকতে হচ্ছে। প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে ঢাকায়। আমার বয়স ৬৪ বছর। যেসব অভিযোগ কিছু সংখ্যক শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে করেছেন, তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্বে আমার এই জীবনে কেউ করতে পারেননি। সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আমাকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে। সঠিক আয়কর প্রদান করি কিনা – তা থেকে শুরু করে আমাদের কি সম্পদ আছে, তা তন্ন তন্ন করে তারা খুঁজেছে। আমাকে নত করতে পারেনি। সততা, নীতি নিষ্ঠা এবং সৎ সাহস – এ ছাড়া আমার আর কিছু নেই। কেউ তা হরণ করতে পারে না। আমি তা হতে দেব না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় চ্যান্সেলর, সনির্বন্ধ আবেদন আপনার কাছে। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ গভীরে খতিয়ে দেখুন। যে কলঙ্ক তিলক আমার উপর লেপন করা হয়েছে, তা মুছে না ফেলেতো আমি এই ক্যাম্পাস ত্যাগ করবো না।

মো. আনোয়ার হোসেন

উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[১৭ই জুলাই ২০১৩ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত]

Image